গেইল তাণ্ডবে রঙিন রংপুর

নিজেদের ইনিংস শেষ হতে বাকি আর মাত্র এক বল। এমন সময় অবলীলায় সিঙ্গেল হয়, অথচ ক্রিস গেইল রানের জন্য দৌড়ালেন না। লংঅন বাউন্ডারি লাইনের সামান্য আগে থেকে বল তুলে ফেরত পাঠালেন কিয়েরন পোলার্ড আর সেটি হয়ে থাকল ঢাকা ডায়নামাইটসের বোলারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলার প্রতীকী এক ছবিও। এর আগেই তো মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ছক্কার ফোয়ারা ছুটিয়ে ফেলেছেন রংপুর রাইডার্সের শিরোপা স্বপ্নের মধ্যমণি। সিঙ্গেল নিয়ে তিনি শেষ বলেও আরেকটি হাঁকানোর সুযোগ ছাড়বেন কেন?
ছাড়লেনও না। যে বলে সিঙ্গেল নিলেন না, তার আগের দুই ডেলিভারিতেও তাঁকে ২২ রানে জীবন দেওয়া সাকিব আল হাসানকে মারলেন দু-দুটো ছক্কা। ইনিংসের শেষ বলে ছক্কা মারলে যেটি হতো, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া সেই নতুন এক বিশ্বরেকর্ড গড়তেও বাকি রাখলেন না। ২০১৩ সালের আইপিএলে বেঙ্গালুরু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে পুনে ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে নিজের টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ ১৭৫ রানের ইনিংস খেলার পথে মেরেছিলেন এক ম্যাচের ইতিহাস সর্বোচ্চ ১৭ ছক্কা। এবারের বিপিএল ফাইনালে নিজেদের ইনিংসের শেষ বলে সাকিবকে মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারা ছক্কাটি যে ম্যাচে তাঁর ১৮ নম্বর!
অর্থাৎ ৬৯ বলে এই জ্যামাইকানের হার না মানা ১৪৬ রানের ইনিংসের ১০৮ রানই ছক্কা থেকে আসা। ছক্কার বিশ্বরেকর্ডে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর ২০তম সেঞ্চুরি রংপুর রাইডার্সের স্কোরও এমন জায়গায় নিয়ে গেল যে সেটি তাড়া করতে নামলে চাপে টালমাটাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রায় সব প্রতিপক্ষেরই। সেই সম্ভাবনা সত্যি হলো ঢাকা ডায়নামাইটসের ক্ষেত্রেও। গেইলের দানবীয় ইনিংসের সমুচিত জবাবের আশা ছিল যাঁদের ব্যাটে, সেই এভিন লুইস ও পোলার্ড স্কোরবোর্ডে ২৯ রান জমা হতে না হতেই সাজঘরে। ততক্ষণে সব মিলিয়ে ৪ উইকেট হারিয়ে বসা ঢাকা ডায়নামাইটসেরও শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্নে পেরেক ঠোকা মোটামুটি শেষ।
ততক্ষণে গেইলের ছক্কা ফোয়ারার ধারাবাহিকতায় রংপুর রাইডার্স শিবিরও প্রথমবারের মতো শিরোপার সৌরভে মুখরিত হতে শুরু করে দিয়েছে। নতুন মালিকানায় যাওয়া দলটির জন্য এরপর অপেক্ষা ছিল জয়ের ব্যবধান নির্ধারিত হওয়ার। শুরুর ধাক্কায় বিপর্যস্ত সাকিব কিংবা শহীদ আফ্রিদিরা জয়োৎসবের অপেক্ষা খুব বিলম্বিতও করতে পারেননি আর। ৫৭ রানের জয়ে উৎসবে মাতোয়ারা রংপুরের ‘জয়ের লড়াই’ও শেষ দারুণ দাপটে শিরোপা ছুঁয়েই। বিপিএলের নতুন চ্যাম্পিয়ন রংপুর রাইডার্স অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও একই সঙ্গে নতুন উচ্চতায়। পাঁচ আসরের মধ্যে চারবারই যে অধিনায়ক হিসেবে ট্রফি ছুঁলেন তিনি।
ট্রফি জেতার পথে প্রতিপক্ষের ইনিংসে প্রথম ধাক্কাটিও তাঁরই দেওয়া। গেইলের ব্যাটে স্কোরবোর্ডে ২০৬ রান জমা হওয়ার পর বোলিংয়ে নেমে ইনিংসের তৃতীয় বলেই এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন ঢাকা ডায়নামাইটসের ওপেনার মেহেদী মারুফকে (০)। স্কোরবোর্ডে আগেরবারের চ্যাম্পিয়নরা তখনো কোনো রানই জমা করেনি। পরের ওভারে অফস্পিনার সোহাগ গাজী ফেরান জো ডেনলিকেও (০)। তাতেও ঢাকার অত দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না, কারণ এভিন লুইস তো ছিলেন। নিজের দ্বিতীয় ওভারে এই বিধ্বংসী ক্যারিবীয়ও সোহাগের দ্বিতীয় শিকার। অবশ্য তাঁকে ফেরানোয় অধিনায়ক মাশরাফির নেওয়া দুর্দান্ত ক্যাচটিরও ভূমিকা কম নয়।
২৯ রানে রুবেল হোসেনের বলে পোলার্ডও যাওয়ার পর ম্যাচ থেকে ঢাকা ছিটকে গেলে সাকিব কিংবা আফ্রিদির ব্যাটে কিছু হলেও আশা টিকে ছিল। কিন্তু সেই আশাও দল স্কোরবোর্ডে ৯০ পেরোনোর আগেই শেষ। দুজনই শিকার নাজমুল ইসলামের। উইকেট পাওয়া সাপনৃত্যে উদ্যাপনের জন্য নজরকাড়া বাঁহাতি এই স্পিনার দলের শিরোপা জয়েও রাখলেন নিজের ছাপ। আর শিরোপায় ম্যাচের প্রথম ইনিংস শেষেই অদৃশ্য ছাপটা দিয়ে রেখেছিলেন গেইল। অথচ টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামার পর তাঁকে খুব একটা চেনারই উপায় ছিল না।
থাকবে কিভাবে? শুরু থেকেই ব্যাট হাতে তোপ দাগতে অভ্যস্ত বিধ্বংসী জ্যামাইকান এদিন শুরু করলেন আশ্চর্য নিস্তরঙ্গতায়। এ কারণেই পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে সেঞ্চুরি করা জনসন চার্লসকে হারিয়ে রংপুর তুলল মাত্র ৪১ রান। পরে বোঝা গেল যে ওই সময়টা আসলে ছিল ঘূর্ণিঝড় আসার আগে গুমট হয়ে থাকা আবহাওয়া। শেষ পর্যন্ত থেকে ম্যাচভাগ্য আবারও একাই নির্ধারণ করে দেবেন বলে শুরুতে ওই রক্ষণ নিয়েছিলেন গেইল। রক্ষণের খোলস ছেড়ে বেরোলেন যখন, তখন ঢাকার বোলারদের ডেলিভারিগুলোও দেদার বাতাসে ভেসে সীমানা ছাড়া হতে শুরু করল। আর টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দেওয়া কথাটাও এদিন রাখলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। বলেছিলেন যে যথাসাধ্য গেইলকে স্ট্রাইক দেওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি।
তাঁদের জুটি যেহেতু সেভাবে জমছিলই না, তাই নিজের কথাও রাখা হয়নি ম্যাককালামের। ফাইনালে তা পারলেন। পারলেন বলেই দলের সংগ্রহে তাঁদের অবদানের ফারাকটাও হলো আকাশ-পাতাল। অথচ ৯ ওভার শেষে তাঁরা কাছাকাছিই ছিলেন। গেইল যেখানে ২৭ বলে ৩৩, সেখানে ম্যাককালামের ১৯ বলে ২২। ২০ ওভার শেষে যেটি গিয়ে দাঁড়াল এ রকম : গেইল বিপিএলের ইতিহাস সর্বোচ্চ ৬৯ বলে ১৪৬* আর ম্যাককালাম ৪৩ বলে ৫১*!
গেইল এমন চেহারায় দেখা দিয়েছিলেন যে ম্যাককালামের খুব বেশি কিছু করারও ছিল না তেমন। তাই তিনি দেখলেন আর গেইল মারতে থাকলেন। শুরুতে দেখেশুনে খেলায় সেঞ্চুরিটা পেতে লেগে গেল ৫৭ বল। ৩০ বলে নিজের দ্রুততম সেঞ্চুরি করা গেইলের এটি নিজের ধীরগতির কয়েকটি সেঞ্চুরির একটি। এটি করার পথেই পেরিয়ে গেলেন টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১১ হাজার রানের মাইলফলকও। ছোটালেন ছক্কার বৃষ্টি। কাকে কাকে মারলেন? এর চেয়ে জিজ্ঞেস করা ভালো যে কাকে নয়?
মোসাদ্দেক হোসেন, খালেদ আহমেদ, আবু হায়দার, পোলার্ড, আফ্রিদি, সুনীল নারাইন থেকে শুরু করে সাকিব, বাদ যাননি কেউই। সবচেয়ে বেশি চারটি ছক্কা হাঁকিয়েছেন তরুণ পেসার খালেদকে। পোলার্ড, সাকিব আর আফ্রিদিকে তিনটি করে। এই ছক্কার বৃষ্টি শুরু পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মোসাদ্দেককে দিয়ে। এক বলের বিরতি দিয়ে মারা দু-দুটি ছক্কার মাঝখানেই সম্ভবত খুলে গিয়েছিল রংপুরের জয়ের দরজা। ওই বলেই যে শর্ট কাভারে নিজের হাতে যাওয়া গেইলের সহজ ক্যাচ ফেলে দেন ঢাকার অধিনায়ক সাকিব। গেইল তখন ২২ রানে!
নিজের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীতে ওই ক্যাচই শুধু নয়, সাকিব হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলেন ট্রফিটাও। শেষ বিচারে ওই ক্যাচ ফেলাই তো খুলে দিয়েছিল গেইলের ছক্কার বিশ্বরেকর্ডের পথ, যে রেকর্ড শিরোপার সৌরভ ছড়িয়েছে রংপুরেও!